মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৭

জানাজার নামাযঃ প্রেক্ষিত মুনাজাত

জানাজার পরে মুনাজাত নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ বলেন এটি শক্ত বিদয়াত। করা যাবে না। করলে গুনাহ হবে। আবার কেউ বলেন এটি মুস্তাহাব। এইরকম বিরোধপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কিভাবে নিব? এরকম বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার পন্থা কি? সে সম্পর্কে একটি কিতাব লিখেছেন ভারতের বিখ্যাত আলেম শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী রাহঃ। কিতাবটির নাম হলো “আল ইনসাফ ফী বায়ানি আসবাবিল ইখতিলাফ।” কোন বিষয়ে যদি মতবিরোধ দেখা দেয়, মত পার্থক্যের সৃষ্টি হয় তাহলে ঐ বিষয়টির পক্ষে বিপক্ষে সরাসরি সহীহ হাদীস খুজতে হবে। যেমন জানাজার পর মুনাজাত করা শক্ত বিদয়াত এর পক্ষে সরাসরি হাদীস পেশ করতে হবে। অপরদিকে যারা জানাজার পর মুনাজাত করা মুস্তাহাব ফতোয়া দেন তাদেরকেও কিভাবে করলে মুস্তাহাব তার পক্ষেও সরাসরি হাদীস পেশ করতে হবে। যদি জানাজার পর মুনাজাত বিদয়াতের পক্ষে সরাসরি হাদীস পাওয়া যায় তাহলে সেটা শক্ত বিদয়াত, নিষিদ্ধ,বাতিল। আবার অপরদিকে জানাজার পর মুনাজাত করার পক্ষে হাদীস পাওয়া যায় তাহলে সেটি গ্রহনযোগ্য, মুস্তাহাব হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ পর্যন্ত যারাই জানাজার পরে মুনাজাত করার বিপক্ষে অবস্থান করছেন তারা সরাসরি নিষিদ্ধ এ ধরনের কোন হাদীস দেখাতে পারেন নাই।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যারা জানাজার পরে মুনাজাতের পক্ষে তারা কি পেরেছে? না। মুনাজাত করতেই হবে, আবশ্যক এ ধরনের হাদীস তারাও দেখাতে পারে নাই। তাহলে প্রশ্ন হলো আমাদের পূর্ববতী মুহাক্কেক আলেমগন, আউলিয়াগন কেন করলেন? তারা কি বিদয়াত করেছেন? একজন মানুষ সারা জীবন বিদয়াত করে ওলী হতে পারে? পৃথিবীতে কোন ওলী, নিজেকে আল্লাহর ওলী দাবী করেছেন, এটা কি কখনও শুনেছেন? না কখনও শোনা যায় নাই? তাহলে তারা যে আল্লাহর ওলী ছিল এর প্রচার হলো কেমনে? বুখারী শরীফের হাদীস এসছে, “আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন তখন তিনি জীবরীলকে ডেকে বলেন إن الله يحب فلانا فأحببه নিশ্চই আল্লাহ অমুক ব্যাক্তিকে ভালোবাসেন অতএব তুমিও তাকে ভালোবাস। জীবরীলও ভালোবাসতে থাকেন। অতপর তিনি আকাশবাসীদের নিকট ঘোষনা করে দেন إن الله يحب فلانا فأحبوه আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন। কাজেই তোমরাও তাকে ভালোবাস। তখন আকাশবাসীরাও তাকে ভালোবাসতে শুরু করে। ثم يوضع له القبول في الأرض অতপর পৃথিবীতেও তাকে গ্রহনযোগ্য করার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে তারা কেমন গ্রহনযোগ্য হন? তারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন সত্য তাদের নাম চির অমর হয়ে আছে। যেমনঃ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি রাহঃ, কারামত আলী জৈনপুরী রাহঃ, ফুরফুরার আবু বকর সিদ্দীক রাহঃ, ছারছীনার নেছার উদ্দীন রাহঃ, তেতাভূমির আবদুর রহমান রাহঃ, ত্রিপুরার সুলতান আহমেদ রাহঃ, আশরাফ আলী থানবী রাহঃ। কোন বিদয়াতী, পাপী আল্লাহর ওলী হতে পারে? না! কখনই নয়।
তারা যেভাবে জানাজার পর মুনাজাত করতেন তাকে শক্ত বিদয়াত বলার মতো দুঃসাহস যারা করবে, বুঝতে হবে তাদের দৃষ্টি শক্তি এখনো পূর্নতা লাভ করে নাই। জ্ঞানের জগতে এখনো শিশু। কেন? জানাজার নামাযের পর কাতারবদ্ধ অবস্থায় কেউ যদি মুনাজাত করে সেটা শক্ত বিদয়াত হতে পারে। কিন্তু যদি জানাজার নামাযের পর কাতার ভেঙ্গে ইসালে সওয়াবের নিয়তে পৃথকভাবে দোয়ার ব্যবস্থা করা হয় সেটি অতি উত্তম, মুস্তাহাব। জানাজার নামাযের পর কাতার ভেঙ্গে পৃথক দোয়া করলে মৃত ব্যক্তির উপকার হয়। হাদীস শুনেন, বুলুগুল মারাম কিতাবুল জানায়েজ مَا مِنْ رَجُلٍ مُسْلِمٍ يَمُوتُ, فَيَقُومُ عَلَى جَنَازَتِهِ أَرْبَعُونَ رَجُلًا “যদি মুসলিম মারা যান আর তার জানাজায় চল্লিশজন মুসলিম ব্যাক্তি হাজির হয় তবে মৃত ব্যাক্তির জন্যে তাদের সুপারিশ আল্লাহ কবুল করে থাকেন।”  এ হাদীসের ব্যাখ্যায় সুবুলুস সালাম এর মধ্যে এসছে, وأن شفاعة المؤمن نافعة مقبولة عنده تعالى “নিশ্চই মু’মিনদের শাফায়াত মৃতের জন্য উপকারী এবং আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্য।” অতএব জানাজার নামাযের পর কাতার ভেঙ্গে শুপারিশের নিয়তে পৃথক দোয়া করলে যদি মৃত ব্যক্তির উপকার হয়, তাহলে আমাদের দোয়া করতে সমস্যা কি? 
মুসলিম শরীফের হাদীস إذا حضرتم المريض أو الميت فقولوا خيرا فإن الملائكة يؤمنون على ما تقولون “যখন তোমরা অসুস্থ অথবা মৃত ব্যাক্তির জানাজায় উপস্থিত হও তখন তোমরা তার সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলো কেননা ফেরেশতারা তোমাদের কথার উপর আমীন আমীন বলতে থাকে।” এ হাদীসের ব্যাখ্যায় شرح النووي على صحيح مسلم কিতাবের মধ্যে এসছে, فيه الندب إلى قول الخير حينئذ من الدعاء والاستغفار “তোমরা তার জন্য দোয়া ও ইসতেগফারের সময় ভালো ভালো কথা বলবে।”  
শুধু তাই নয় বুলুগুল মারামে আরো একটি হাদীস এসছে, إِذَا صَلَّيْتُمْ عَلَى اَلْمَيِّتِ فَأَخْلِصُوا لَهُ اَلدُّعَاءَ যখন তোমরা মৃত ব্যক্তির জানাজা আদায় করলে তখন আন্তরিকভাবে তার জন্য দোয়া কর।”  এ হাদীসে রাসূল সাঃ নামাযের পশাপাশি পৃথকভাবে দোয়ার কথা বলেছেন। যদি কেউ এ হাদীসে বর্নিত দোয়াকে নামাযের মধ্যের দোয়া প্রমান করতে চান সেটি ভুল হবে। কেননা আল্লাহ বলেন, সূরা আহযাবে ৫৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, فَإِذَا طَعِمْتُمْ فَانْتَشِرُوا “যখন খাওয়া শেষ হবে তখন ছড়িয়ে পড়।” এই আয়াতে খাওয়ার পর পর জমিনে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ করা হয়েছে মধ্যখানে নয়। তদ্রুপ এই হাদীসে জানাজার নামাযের পর আন্তরিকভাবে দোয়া করতে নির্দেশ করা হয়েছে। তাই দোয়া করতে হলে অবশ্যই শর্ত হলো কাতার ভেঙ্গে পৃথকভাবে দোয়া করতে হবে।  الله اعلم

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন