শনিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৬

সুন্নাত ও বিদয়াত প্রসঙ্গে বিভ্রান্তি নিরসন



সুন্নাত ও বিদয়াত পরস্পর বিরোধী বিষয়। এই বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে। সুন্নাত ও বিদয়াতের প্রকৃত পরিচয় অনুধাবন করতে আমরা অনেকেই ব্যর্থ হচ্ছি। কিন্তু এ বিষয়ে প্রত্যেকের স্বচ্ছ ধারনা থাকা অত্যন্ত জরুরী। নতুবা বিভ্রান্তির বেড়জালে পতিত সম্ভাবনা রয়েছে। সুন্নাত ও বিদয়াতের প্রকৃত পরিচয় জানতে হলে যে কোন একটি সনাক্ত করতে হবে। প্রথমত কাকে সনাক্ত করব? দুটি বিষয়ের মধ্যে মৌলিক বিষয় হলো সুন্নাত। বিদয়াত বুঝতে হলে সর্বপ্রথম সুন্নাতের সংজ্ঞাকে বুঝতে হবে। কেননা রাসূল সাঃ সুন্নাত ও বিদয়াত সংক্রান্ত হাদীসগুলোতে প্রথম সুন্নাতের তারপর বিদয়াতের পরিচয় দিয়েছেন। যেমন রাসূল সাঃ বলেছেন, فَعَلَيكُمْ بِسُنَّتِي وسُنَّةِ الخُلفاء الرَّاشدينَ المهديِّينَ ، عَضُّوا عليها بالنَّواجِذِ ، وإيَّاكُم ومُحْدَثاتِ الأمور ، فإنَّ كُلَّ بِدعَةٍ ضَلالةٌ  “তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত আকড়ে ধর। মাড়ির দাত দিয়ে আকড়ে ধর। এবং নতুন উদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকো। কেননা সকল নতুন বিষয় পথভ্রষ্টতা।” কেউ কেউ বিদয়াতকে বুঝার জন্যে এমন সংকীর্ন পথে পা বাড়িয়েছেন যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হয়নি। ফলে এমন কিছু দলীল প্রমানের সাথে সংঘর্ষ বাধিয়েছেন যা সমাজে ফিতনার সৃষ্টি করেছে।

সুন্নাত শব্দটি বিভিন্ন পরিভাষায় পৃথক পৃথক অর্থ হয়। হাদীস বিজ্ঞানীদের পরিভাষায় সুন্নাত হচ্ছে রাসূল সাঃ এর মুখের কথা, কাজ, সমর্থন ও অনুমোদনের বর্ননা। যাকে প্রচলিত ভাষায় হাদীস বলা হয়ে থাকে। ফিকাহ শাস্ত্রের পরিভাষায় সুন্নাত এমন কাজকে বলা হয় যা ফরজ বা ওয়াজীব নয় বটে কিন্তু রাসূল সাঃ তা প্রায়ই করতেন। আর আমাদের আলোচ্য বিষয়ে যে সুন্নাত তার অর্থ হলো নিয়ম পদ্ধতি, রীতি-নীতি। রাসূল সাঃ এর কর্ম নির্দেশ পালনে ও বর্জনে তাঁর প্রদর্শিত পন্থা। অর্থাৎ কোন বিষয় গ্রহন ও বর্জন করার ক্ষেত্রে রাসূল সাঃ কোন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। আর সেটাই খুলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ। তাই জীবন পরিক্রমায় নতুন কোন বিষয়ের অবতারন হলে পবিত্র সুন্নাহর ছাঁচে ফেলে পরিমাপ করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হবে। পরিমাপে উত্তীর্ন হলে গ্রহন নতুবা পরিত্যাগ করতে হবে। পরিমাপে অনুত্তীর্ন বিরোধপূর্ন বিষয়গুলোকেই বলা হয় বিদয়াত। এবার আসুন রাসুল সাঃ নতুন কোন বিষয় সামনে আসলে কিভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন হাদীসের আলোকে তা জানার চেষ্টা করি।

বুখারী শরীফের হাদীস “রেফাহ বিন রাফে থেকে বর্নিত তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাঃ এর পিছনে নামায পড়তাম। তিরি রুকু থেকে মাথা উঠাবার সময় বলতেন, سمع الله لمن حمده তখন তাঁর পিছনে দাড়ানো একজন সাহাবী বলে উঠল ربنا ولك الحمد حمدا طيبا مباركا فيه নামায শেষ করে রাসূল সাঃ জিজ্ঞাসা করলেন অতিরিক্ত নতুন কথাগুলো কে বলেছে? সাহাবী বলল আমি। রাসূল সাঃ বললেন আমি দেখলাম ত্রিশজন ফেরেশতা প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়েছে কে আগে সওয়াবগুলো লিখবে?” এ হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, সাহবী অতিরিক্ত যে দোয়াটি পাঠ করেছিলেন তা রাসূল সাঃ এর শেখানো কোন দোয়া ছিল না। সাহাবী নিজ থেকেই তা পড়ে ছিলেন। তাই এটি একটি নতুন কাজ। আর এ বিষয়ে রাসূল সাঃ সাহাবীকে উৎসাহিত করলেন যে, তুমি যে অতিরিক্ত দোয়াটি পাঠ করেছ তার সওয়াব লেখার জন্যে ফেরেশতারা প্রতিযোগীতা করছে। এ কাজটি শরীয়াতের বিরোধী ছিল না। অতএব প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এমন নতুন কাজ যা রাসূল সাঃ এর শেখানো পদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বিরোধপূর্ন নয় তা পরিত্যজ্য, প্রত্যাখ্যাত হতে পারে না। বরং তা কল্যানকর এবং বৈধ। এধরনের কিছু আমল হলো মিলাদ কিয়াম, হাত তুলে মুনাজাত, আদব রক্ষা করে বিভিন্ন তরীকায় যিকির আযকার, মুরাকাবা মুশাহাদা ইত্যাদি।

শুধু তাই নয় এ ধরনের উত্তম পদ্ধতি প্রচলনের ব্যাপারে রাসূল স্বয়ং নিজেই উৎসাহিত করেছন। মুসলিম শরীফে এসছে, من سن فى الاسلام سنة حسنة فله اجرها “যে ব্যক্তি ইসলামে উত্তম কিছুর প্রচলন করল সে তার বিনিময়ে সওয়াব পাবে।” হাদীসে বহু প্রমান রয়েছে যে কতিপয় সাহাবী এমন এমন কিছু দোয়া, আমল, যিকির করতেন যা ইতিপূর্বে রাসূল সাঃ করেন নি বা করতে বলেন নি। এগুলো তাঁদের মনের গভীর বিশ্বাস থেকে ভালো মনে হয়েছে তাই করেছেন। পরবর্তীতে রাসূল সাঃ তা অনুমোদনও করেছেন। এ ধরনের ভালো কাজের ব্যাপারে আল্লাহ পাক কুরআনে উৎসাহ দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ  “তোমরা ভালো কাজ করলে সম্ভবত সফলকাম হবে।”

বিদয়াত হলো ঐ সকল নতুন কাজ যা মানুষকে অকল্যান, গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যায়। বিদয়াত আকীদাগত ও আমলগত উভয় প্রকারের হতে পারে। আকীদাগত বিদয়াত মু’মিনের ঈমানকে নষ্ট করে দেয়। যেমন, খারেজী, রাফেজী, মু’তাজিলা, কাদিয়ানী, শিয়া এবং কট্টরপন্থী লা মাজহাবী। আমলগত বিদয়াত আমলের সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করে। তাই আকীদাগত বিদয়াত থেকে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে। এ ধরনের কতিপয় বিদয়াত হলো আল্লাহকে দৈহিক আকৃতিতে বিশ্বাস করা, নবী রাসূলগন কবরে জীবিত তা অস্বীকার করা, রাসূল রওজা শরীফ জিয়ারত করাকে অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান করা, তাকলীদ ও তাসাউফকে কুফুরী মনে করা, কবরকে সেজদা করা ইত্যাদি। আল্লাহ আমাদেরকে বিদয়াত থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

1 টি মন্তব্য: